লেখক: নীলিমা সুলতানা
বই: “ভারতের হিজরে সমাজ”
লেখক: অজয় মজুমদার ও নিলয় বসু
প্রকাশকাল- ১৯৯৭ ( দীপ প্রকাশন)
হিজরে বা হিজরা সমাজের অস্তিত্ব সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানে। তবে সেই জানাটা বড় ভাসাভাসা, ভুলে ভরা। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের বাইরে বই আকারে বিশদে তেমন কোন লেখা পাওয়া যায় না। ফেসবুকে এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক লেখা পড়েছি যার বেশিরভাগই ভুল তথ্যে ভরা। এই বই ছাড়া বাংলা ভাষায় হিজরা জনগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা ধর্মী নন ফিকশন অন্য কোন বই আছে কিনা আমার জানা নেই। সেই হিসেবে হিজরা জনগোষ্ঠী নিয়ে কারো কৌতূহল থাকলে এই বইটি সহায়ক হতে পারে। বইটি যদিও ভারতের হিজরা সমাজ নিয়ে লেখা তবুও বাংলাদেশের হিজরা সমাজের সাথে এর তথ্যের খুব বেশি তফাত থাকার কথা না। উপমহাদেশের হিজরা সম্প্রদায়গুলো প্রায় একই সংস্কৃতি বহন করে এবং এদের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ ও রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের হিজরা সমাজ সম্পর্কে কিছু তথ্য ও বইটিতে রয়েছে।
তবে বইটি ১৯৯৭ সালে প্রথম প্রকাশিত ও এর তথ্যের ভিত্তি সেই সময়ের বা তার সামান্য আগের। গত তেইশ চব্বিশ বছরে এই সমাজের মূল্যবোধ ও জীবনযাত্রায় হয়তো কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন থাকতে পারে যা এই বইয়ে পাওয়া যাবে না। তেমনি এই বইয়ে ব্যবহৃত অনেক টার্মিনোলজি এখন অচল এবং পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ট্রান্সভেসটাইট এর স্থলে এখন ক্রসড্রেসারই বহুল প্রচলিত শব্দ, রুপান্তরকামীদের এই বইয়ে ট্রান্সসেক্সুয়াল বলে অভিহিত করা হয়েছে বর্তমানে রুপান্তরিতদেরই শুধুমাত্র ট্রান্সসেক্সুয়াল বলে অভিহিত করা হয়, রুপান্তরকামীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি। হিজরাদের নিজেদের মধ্যে কিংবা পুরুষদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে সমকামী শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেই ধারণা ও বর্তমানে পরিত্যাক্ত। তাছাড়া হিজরাদের অধিকার ও আইনি স্বীকৃতির ক্ষেত্রে ও এসেছে কিছু পরিবর্তন সেসব তথ্য স্বাভাবিক ভাবেই এই বইয়ে নেই । তবে বইয়ের মূল তথ্য ও বিশ্লেষণ এখনো একইভাবে সত্য ও প্রাসঙ্গিক।
হিজরাদের নিয়ে বলতে গেলে শুরুতেই যে ভুলটা মানুষ করে থাকে তা হচ্ছে তাদের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে ভুল। অনেকেরই ধারণা হিজরা গোষ্ঠীর মানুষ মাত্রই জন্মগতভাবে উভলিঙ্গ। এই ধারণাটি পুরোপুরি ভুল। প্রথমত উভলিঙ্গ হয়ে জন্ম নেয় খুব কম সংখ্যক মানুষ, অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের নির্দিষ্ট লিঙ্গ পরিচয় দেওয়া সম্ভব আর যাদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয় তাদের অনেকেও শারীরিক ও মানসিক অন্য প্রতিবন্ধকতার কারণে হিজরা জনগোষ্ঠীতে যোগ দেন না বা দেয়া সম্ভব নয়। তাই প্রকৃতপক্ষে হিজরা সমাজে উভলিঙ্গ মানুষের সংখ্যা খুবই কম। এই বইয়ে দেওয়া তথ্যমতে সেই সময়ে সর্বভারতীয় হিজরাদের মধ্যে উভলিঙ্গ ছিলেন মাত্র ২%, আর পশ্চিমবঙ্গে ৫%। এই অনুপাতে খুব বেশি পরিবর্তন এখনো হবার কথা নয়। আরেকটি ভুল ধারণা হচ্ছে হিজরা মাত্রই ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামী। এই ধারণাটিও ভুল। হিজরাদের মধ্যে রুপান্তরকামী বা আকুয়ারা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ছিবড়ি বা মহিলা অথবা জেনানা বা পুরুষ। এই দুই শ্রেণির মানুষের হিজরা গোষ্ঠীতে যুক্ত হবার কারণ মূলত অর্থনৈতিক এবং অল্প পরিশ্রমে বেশি আয়ের সুযোগ। ছিবড়িরা সংখ্যায় কম ও হিজরাদের মধ্যে নিপীড়িত হলেও জেনানা বা পুরুষরা হিজরাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দলের নিয়ন্ত্রণ এদের হাতেই থাকে। তবে হিজরাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যারা সংখ্যায় তার হচ্ছে ছিন্নি বা খোজা। এরা হচ্ছে সেই শ্রেণি যারা জন্মগতভাবে পুরুষ ছিলেন এবং পরবর্তীতে যাদের পুরুষাঙ্গ ছেদন করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আকুয়া বা রুপান্তরকামীরা নিজেদের পুরুষাঙ্গ ছেদন করিয়ে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে নারী হবার স্বপ্ন দেখে, পুরুষত্বহীন জেনানারাও অনেকসময় স্বেচ্ছায় খোজা হয়। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো জোর করে অথবা ভুল বুঝিয়ে অনেক স্বাভাবিক মানুষকেও ছিন্নি বানানো হয় শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে। সেই মানুষটির আর নিজের পরিবার ও সমাজে ফেরার উপায় থাকে না বলে বাধ্য হয়ে সে হিজরা সম্প্রদায়েই থাকতে বাধ্য হয়।
ক্যাসস্ট্রেশন বা খোজাকরণের ইতিহাস অনেক পুরোনো, প্রাচীন মিশরে, আসিরীয়দের মধ্যে এই প্রথা ছিল। এই প্রথা ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রীক, রোমান বা অন্যান্য সভ্যতায়। পারস্য দেশ হয়ে এই প্রথা এসেছিল উপমহাদেশে প্রাক মৌর্য আমলেই। তবে সেই খোজাকরণ ছিল জোরপূর্বক, মূলত দাসদেরই খোজা করা হতো। খোজা প্রথার ইতিহাস এই বইয়ে উল্লেখ করা হলে ও খোজাকরণ প্রথার সাথে হিজরাদের সরাসরি সম্পর্ক তো নেই।
হিজরাদের এই ছিন্নি বানানোর প্রক্রিয়া টি অবৈজ্ঞানিক ও নৃশংস। নিজেরা মিলে অথবা হাতুড়ে ডাক্তারদের সহায়তায় এই কাজ করা হয় বলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বা ইনফেকশন হয়ে প্রায় অর্ধেক মানুষ ই এতে মারা যায়। এই প্রক্রিয়াকে ওরা বলে নির্বাণ এবং বিশ্বাস করে এর মাধ্যমে তারা পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হয়। আমার বিশ্বাস বর্তমানে এই পদ্ধতি আরও উন্নত হয়েছে যেহেতু উন্নততর চিকিৎসা এখন পাওয়া সম্ভব। হিজরাদের আদিম মূল পেশা নবজাতকের বাড়িতে গিয়ে নাচগান করে অর্থ সংগ্রহ এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে নগরানয়নের কারণে। চাঁদাবাজি কিংবা ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়াও অনেকে মূল ধারার অনেক পেশায় এখন যুক্ত হচ্ছেন। চোরাচালান বা অবৈধ কারবারের হাতিয়ার হিসেবে ও এদের ব্যবহার করে অপরাধ জগতের মানুষেরা। এছাড়া আদিমতম পেশা গণিকাবৃত্তিতে হিজরাদের অংশগ্রহণ অতীতেও ছিল এখনো আছে। মূলত অল্পশিক্ষিত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষেরাই এই সমাজে যোগ দেয়। হিন্দু, মুসলিম বা যেকোন সম্প্রদায়ের মানুষই একটি গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে একত্রে একটি হিজরা দল গড়ে তোলে যার প্রধান হচ্ছেন একজন যাকে তারা গুরু মা বলে। বাকি সবাই গুরুমায়ের শিষ্য বা মেয়ে।
আবার অনেক ক্ষেত্রে দলহারা বা দলভাঙ্গা অনেক হিজরা ও পাওয়া যায় যারা একদল থেকে আরেক দলে ঘুরে বেড়ায়। হিন্দু বা মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাসে যাই হোক এরা আজমীর শরীফ বা অন্যান্য পীরের উরসে অংশগ্রহণ করে। আবার গুজরাটে রয়েছে এদের নিজস্ব দেবী বহুচেরা মাতার মন্দির, করে থাকে ঢোল পূজাও। তামিলনাডুর আরাবান দেবতার( অর্জুন পুত্র ইরাবান) একটি মন্দিরেও এরা বাৎসরিক উৎসবে যোগ দেয়। ছট পরব, কালী পূজা, ঈদ ও শবেবরাতের মতো উৎসবও এরা পালন করে। নিজেদের নিরাপত্তা ও সুবিধার্থে এরা ব্যবহার করে বেশকিছু সাংকেতিক শব্দ রয়েছে, বিয়ে বা মৃত্যু পরবর্তী এদের অনুষ্ঠানেও আছে স্বাতন্ত্র্য। নিজেদেরকে এরা ভাবে মহাভারতের অম্বার উত্তরসূরী, সেই অম্বা যিনি ভীষ্মের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য পরের জন্মে শিখন্ডী হয়ে জন্মেছিলেন। শিখন্ডীর মতোই এরা পূর্বের জন্মে নারী ছিলেন, পরের জন্মে নারী হবেন এই তাদের বিশ্বাস। হিজরারা মূলত নারীর পোশাক ও সাজসজ্জা পরিধান করলেও সেই পোশাক নির্দিষ্ট কিছু নেই, যে সমাজে বা এলাকায় তাদের বাস সেই সমাজের নারীদের মতোই তারা পোশাক আশাক পরে থাকে। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে পুরুষদের নারীর পোশাক পরার বা নিজেকে নারী ভাবার উদাহরণ আছে বৈষ্ণবদের মধ্যে, সুফিবাদে এবং অনেক প্রাচীন বিলুপ্ত ধর্মে। তবে ধর্মীয় বিশ্বাস বা আচারের বাইরে এমন গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ পৃথিবীর অন্যত্র খুব বেশি দেখা যায় না। ওমানে কানিয়াত/জেনিথ নামে হিজরাদের কাছাকাছি একটি সম্প্রদায় আছে যারা নিজেদের মেয়ে ভাবে এবং নারী ও পুরুষের মাঝামাঝি পোশাক পরে থাকে, উভয় লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য এদের মধ্যে ও বিদ্যমান।
হিজরা জনগোষ্ঠীর উৎপত্তি ও তাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে এই বইয়ে কোন আলোকপাত করা হয় নি সম্ভবত এই বিষয়ে প্রামাণ্য তথ্যের অভাবে। এটিই এই বইয়ের একমাত্র দূর্বলতা বলে আমার মনে হয়েছে। এর বাইরে বইটি অনেক তথ্যবহুল। লেখকদ্বয় অনেক পরিশ্রম করে, ঝুঁকি নিয়ে, দীর্ঘ সময় ধরে এই বইয়ের জন্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন যা এ বিষয়ে আগ্রহীদের যেমন কৌতূহল মেটাতে সাহায্য করবে তেমনি ভবিষ্যতে পাথেয় হয়ে থাকবে এই বিষয়ে এমন গবেষণা মূলক রচনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে।